*********************************
দশ বছর যে বাজেট ডঃ অমিত মিত্র পেশ করেছেন, তাঁর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আছে সামাজিক প্রকল্প l কিন্তু স্থায়ী উন্নয়নের জন্য কতটা বরাদ্দ? একটু অন্যভাবে বলি l দুজন গৃহকত্রী l তাদের দুজনেরই হাতেই 5000 টাকা আছে তাদের সন্তানদের জন্য l একজন মা সন্তানের হাতে পুরো টাকা তুলে দেন প্রতিমাসে এবং সন্তান সেই টাকা ফুর্তি করে উড়ায় l মা সন্তানের কাছে খুব প্ৰিয় l দ্বিতীয় মা সেই 5000 খরচ করেন বাচ্চার গৃহশিক্ষক এবং বইপত্রর জন্য l এক্ষেত্রে মা কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় হন সাময়িক ভাবে l কিন্তু কোন মা সঠিক?
অমিত মিত্রর বাজেটও সেই প্রথম মার মত l সরকারের আয়ের অধিকাংশ টাকা গত দশ বছর উনি বিতরণ করে আসছেন মেলা, খেলা এবং বিভিন্ন 'শ্রী' তে l কিন্তু কোথায় তিনি বিনিয়োগ করছেন না? এক, নিয়মিত স্থায়ী সরকারি কর্মী নিয়োগ l দুই, পরিকাঠামো l তিন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ম্যাচিং গ্রান্ট , চার, শিল্প-পরিকাঠামো l চারটি বিষয়ে বিস্তারে ব্যাখ্যা করা যাক l
এক, কেন স্থায়ী সরকারি কর্মী প্রয়োজন এবং কোথায়? এবং কেন নিয়মিত প্রয়োজন এই নিয়োগ? আমাদের দেশের প্রায় সব রাজ্যই নিয়মিত শিক্ষক, ডাক্তার, পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থায় নিয়োগ করে l এসব ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ হওয়া সম্ভব নয় l যে দায়বদ্ধতা কিম্বা পরিষেবা দেবার ইচ্ছা একজন স্থায়ী শিক্ষক বা ডাক্তারের থাকে, তা একজন অস্থায়ী শিক্ষকের বা ডাক্তারের থাকা অসম্ভব l তাছাড়া মাঝপথে তারা চাকরি ছেড়ে চলে গেলে ক্ষতি অনেক বেশী l গবেষণার জন্য তো স্থায়ী শিক্ষক ভীষণভাবে আবশ্যিক l
বিচার বিভাগ বা পুলিস যদি দুর্বল হয়, তার পরিণতি একমাত্র মাৎস্যন্যায় l শুধু সমাজ জীবনে নয় l কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প সর্বত্র এর প্রভাব পড়ে l উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ন্যূনতম বেতন দিতে নিয়োগকর্তার অস্বীকার, সময়ে বেতন দিতে অস্বীকার, বিনা কারণে চাকরি ছাটাই, নিয়ম ভেঙে দিনে 14 ঘন্টা করে সাত দিন কাজ করানো ইত্যাদি l কলকাতায় এই সংস্কৃতি কিন্তু বহুজায়গায় চলছে l এর মধ্যে ব্যাবসায় পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে পেমেন্ট না দেয়া পশ্চিমবঙ্গে মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে l মূল কারণ ধীর ও অপ্রতুল বিচার ব্যাবস্থা l বহু বাঙালি গত চার দশকে ব্যাবসায় পেমেন্ট না পেয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে, কিন্তু কোন বিচার পাননি l
দুই, পরিকাঠামোতে অপ্রতুল বিনিয়োগ l পশ্চিমবঙ্গে চার লেন রাজ্যে সড়ক সম্ভবতঃ 10% এরও কম l দেশের সব রাজ্যে মেট্রো রেলে 50% বিনিয়োগ করলেও পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্যযে মেট্রো পরিকাঠামো বানাতে এক পয়সাও দিচ্ছে না l ফলে চাপ বাড়ছে লোকাল ট্রেনের উপর l গত দুই দশকে কয়েক লক্ষ শহরতলির প্রৌড় কাজ ছেড়েছেন ভিড় বাস বা ট্রেনে চড়তে না পেরে l পরিকাঠামোর অভাবে কলকাতার বিকেন্দ্রীকরণও হচ্ছে না বোম্বে, দিল্লির মত l যার ফলে কমছে কাজের সুযোগ এবং বাড়ছেনা শহরতলির জমির দাম l উদাহরণ হিসেবে, শিয়ালদা স্টেশন থেকে যে কোন দিকে 40 কিমি গিয়ে আমরা যদি জমির দামকে তুলনা করি ছাত্রপাতি শিবাজী টার্মিনাস এর 40 কিমি দূরের কোন জমির সঙ্গে, সেটা অন্ততঃ 20 গুন তো হবেই l অথচ 1966 ই কলকাতা ও বম্বে সবদিক থেকে একই জায়গায় ছিল l গত দশ বছরে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে কল্যাণী রোড, বিটি রোড, বাসন্তী হাইওয়ে কিম্বা যশোর রোডে? উত্তরপ্রদেশ লখনৌ মেট্রো শেষ করে কানপুর মেট্রো শুরু করে দিল যেখানে রাজ্যে 50% খরচ করেছে l অথচ মমতা ব্যানার্জীর 2009 এর বাজেটে ঘোষিত 100 কিমি মেট্রোর মধ্যে মাত্র তিনটি স্টেশন আজ মানুষ ব্যাবহার করছে l JNNURM প্রকল্পে জলপ্রকল্প হয়নি কলকাতার অধিকাংশ শহরতলিতে l তিস্তা সেচ প্রকল্প বিশ বাও জলে l সুবর্ণরেখা, সিদ্ধেশ্বরী নুনবিল, দ্বারকেশ্বর গন্ধেশ্বরী প্রকল্প শুরুই হয় নি l যদিও 'জল ধরো জল ভারো ' রাজ্য সরকারের একটা সাফল্য l এছাড়া সড়ক সম্প্রসারণ নাহলেও গুনগত মানের দিকে রাজ্যের সড়কে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে l
তিন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ম্যাচিং গ্রান্ট : যে কোন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যকে 40% থেকে 50% ব্যয়ভার বহন করতে হয় l কিন্তু রাজ্যে এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে বিনিয়োগের বদলে, সরাসরি মানুষকে টাকা বন্টন করে জনপ্রিয় হওয়া শ্রেয় মনে করেছে l গত দশ বছরে কেন্দ্র থেকে রাজ্য বেশ কিছু বড় প্রকল্পের অনুদান পেয়েছে, যেমন অমৃতসর-ডানকুনি শিল্প করিডোর, লুধিয়ানা-ডানকুনি ফ্রেট করিডোর, মুম্বাই-খড়্গপুর ফ্রেট করিডোর, ইস্টকোস্ট শিল্প করিডোর, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিভিন্ন জাতীয় সড়ক, রেল ওভারব্রিজ, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এমনকি নতুন রেলপথ l মোট বিনিয়োগের পরিমান প্রায় তিন লক্ষ কোটি l চাকরি পেত বহু লোক l তার সঙ্গে স্থায়ী পরিকাঠামো তৈরি হবার ফলে বাড়তো জমির দাম l বিনিয়োগ হত শিল্পে l কিন্তু গত দশ বছর রাজ্যের প্রতিটি বাজেট এই ম্যাচিং গ্র্যান্টের ব্যাপারে প্রায় নীরব থেকে গেছে l ফলে আমাদের দেয়া করের পয়সায় পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে দেশের সব রাজ্যে l শুধু বঞ্চিত হয়েছি আমরা l
চার, শিল্প পরিকাঠামো l শিল্প পরিকাঠামোর জন্য দরকার সড়ক, জল এবং বিদ্যুৎ l সাধারণতঃ জল এনে দেয় সরকারই l. মূল উৎস বাধ বা সেচ খাল l কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নতুন সেচখাল বহুদিন হয় নি l অমিত বাবুও এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন খুবই কম l বিদ্যুতের দাম একটা নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে l কিন্তু বিদ্যুতের দামে পশ্চিমবঙ্গ উপরের দিক থেকে তৃতীয় l গত দশ বছরে অপ্রচলিত পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ক্ষেত্রে রাজ্যের বিনিয়োগ নগন্য l কয়লা বিদ্যুৎ বেশী ব্যাবহারের জন্য বিদ্যুতের দাম এখানে বেশী l এছাড়া, সড়ক তো আগেই বলেছি l দুই লেন রাস্তা শিল্পের পণ্য পরিবহনে অযোগ্য l কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ রাস্তাই চার লেন l কয়েকবছর আগে সংসদে সৌগত রায় নীতিন গতকারীকে রাস্তা নির্মাণে কেন্দ্র বৈষম্য করছে বলে অভিযোগ করায়, নীতিনজি বলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি দিলে উনি সব রাস্তা ন্যূনতম চারলেন বানিয়ে দেবেন l কিন্তু রাজ্য জমি দেয় নি l
এবার উপসংহারে আসি l পরিকাঠামো উন্নয়নের অভাবে রাজ্যে আসছে না শিল্প ও বাণিজ্য l সঙ্গে আছে সরকারের ভুল জমি, সেজ এবং বিদেশী বিনিয়োগ নীতি l 2011 তে জমি আইনে বড়সড় একটা সংস্কার আনা উচিৎ ছিল, যা সরকার করেনি l বিদ্যুতে ভর্তুকি, জলের কর, পুর কর ইত্যাদি ব্যাবস্থার যে আমূল সংস্কার সারা ভারত করছে, পশ্চিমবঙ্গ তাঁর থেকেও বিরত l আসছে না বড় বিনিয়োগ, কমছে সুযোগ এবং উত্তরোত্তর বাড়ছে বেকারের সংখ্যা l চাহিদার থেকে শ্রমিকের জোগান বেড়ে যাওয়ায় কমছে বেতন l কমছে ব্যাবসায় লাভের পরিমান l বিচার বাবস্থা ও প্রশাসনিক অপ্রতুলতায় বাড়ছে শ্রমিক শোষণ l ব্যবসার জগতে চলছে মাৎস্যন্যায় l জীবনে আসছে অস্থিরতা l সরকার সেটাকে সামাল দিতে বহু মানুষকে 100 দিনের কাজের অধীনে আনায় শোষণ কিছুটা কমছে বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও যোগানের সূত্র ধরেই l যত সমস্যা বাড়ছে, সরকার ততই সামাজিক প্রকল্পের সংখ্যা বাড়াচ্ছে l কিন্তু এর তো একটা শেষ আছে? অপরদিকে সফটওয়্যার ইত্যাদি শিল্প রাজ্যে থেকে চলে যাওয়ায়, বেশী বেতনের কর্মীরা ছাড়ছে রাজ্য l খারাপ হচ্ছে আবাসন, গাড়ি থেকে রেস্টুরেন্ট সব কিছুর বাজার l প্রতি বছর এগারো লক্ষ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে এবং সঙ্গে আছে বহু ড্রপআউট l কতদিন এই ভাবে চলবে? স্থায়ী সম্পদ না বানিয়ে কিছু সংখ্যাতত্বের খেলা আর সামাজিক প্রকল্প ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাবে? অমিত মিত্রের বাজেটকে ইতিহাস কিভাবে দেখবে? শুধুই একটা জমা খরচের ইতিহাস? বিধান রায় বলতে আমরা বুঝি হলদিয়া, কল্যাণী, সল্টলেক, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, ডিভিসি, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, বান্ডেল, সান্তালদি l কি রেখে যাবেন মমতা ব্যানার্জী আর অমিত মিত্রের সরকার? কিছু 'শ্রী' এর সমাহার মাত্র?
✍️ সুদীপ্ত গুহ, বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা এবং
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির অর্থনীতি সেলের সহআহ্বায়ক।
০৯.০৭.২০২১, একদিন পত্রিকা।
দশ বছর যে বাজেট ডঃ অমিত মিত্র পেশ করেছেন, তাঁর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আছে সামাজিক প্রকল্প l কিন্তু স্থায়ী উন্নয়নের জন্য কতটা বরাদ্দ? একটু অন্যভাবে বলি l দুজন গৃহকত্রী l তাদের দুজনেরই হাতেই 5000 টাকা আছে তাদের সন্তানদের জন্য l একজন মা সন্তানের হাতে পুরো টাকা তুলে দেন প্রতিমাসে এবং সন্তান সেই টাকা ফুর্তি করে উড়ায় l মা সন্তানের কাছে খুব প্ৰিয় l দ্বিতীয় মা সেই 5000 খরচ করেন বাচ্চার গৃহশিক্ষক এবং বইপত্রর জন্য l এক্ষেত্রে মা কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় হন সাময়িক ভাবে l কিন্তু কোন মা সঠিক?
অমিত মিত্রর বাজেটও সেই প্রথম মার মত l সরকারের আয়ের অধিকাংশ টাকা গত দশ বছর উনি বিতরণ করে আসছেন মেলা, খেলা এবং বিভিন্ন 'শ্রী' তে l কিন্তু কোথায় তিনি বিনিয়োগ করছেন না? এক, নিয়মিত স্থায়ী সরকারি কর্মী নিয়োগ l দুই, পরিকাঠামো l তিন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ম্যাচিং গ্রান্ট , চার, শিল্প-পরিকাঠামো l চারটি বিষয়ে বিস্তারে ব্যাখ্যা করা যাক l
এক, কেন স্থায়ী সরকারি কর্মী প্রয়োজন এবং কোথায়? এবং কেন নিয়মিত প্রয়োজন এই নিয়োগ? আমাদের দেশের প্রায় সব রাজ্যই নিয়মিত শিক্ষক, ডাক্তার, পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থায় নিয়োগ করে l এসব ক্ষেত্রে অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ হওয়া সম্ভব নয় l যে দায়বদ্ধতা কিম্বা পরিষেবা দেবার ইচ্ছা একজন স্থায়ী শিক্ষক বা ডাক্তারের থাকে, তা একজন অস্থায়ী শিক্ষকের বা ডাক্তারের থাকা অসম্ভব l তাছাড়া মাঝপথে তারা চাকরি ছেড়ে চলে গেলে ক্ষতি অনেক বেশী l গবেষণার জন্য তো স্থায়ী শিক্ষক ভীষণভাবে আবশ্যিক l
বিচার বিভাগ বা পুলিস যদি দুর্বল হয়, তার পরিণতি একমাত্র মাৎস্যন্যায় l শুধু সমাজ জীবনে নয় l কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প সর্বত্র এর প্রভাব পড়ে l উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ন্যূনতম বেতন দিতে নিয়োগকর্তার অস্বীকার, সময়ে বেতন দিতে অস্বীকার, বিনা কারণে চাকরি ছাটাই, নিয়ম ভেঙে দিনে 14 ঘন্টা করে সাত দিন কাজ করানো ইত্যাদি l কলকাতায় এই সংস্কৃতি কিন্তু বহুজায়গায় চলছে l এর মধ্যে ব্যাবসায় পণ্য বা পরিষেবা নিয়ে পেমেন্ট না দেয়া পশ্চিমবঙ্গে মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে l মূল কারণ ধীর ও অপ্রতুল বিচার ব্যাবস্থা l বহু বাঙালি গত চার দশকে ব্যাবসায় পেমেন্ট না পেয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে, কিন্তু কোন বিচার পাননি l
দুই, পরিকাঠামোতে অপ্রতুল বিনিয়োগ l পশ্চিমবঙ্গে চার লেন রাজ্যে সড়ক সম্ভবতঃ 10% এরও কম l দেশের সব রাজ্যে মেট্রো রেলে 50% বিনিয়োগ করলেও পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্যযে মেট্রো পরিকাঠামো বানাতে এক পয়সাও দিচ্ছে না l ফলে চাপ বাড়ছে লোকাল ট্রেনের উপর l গত দুই দশকে কয়েক লক্ষ শহরতলির প্রৌড় কাজ ছেড়েছেন ভিড় বাস বা ট্রেনে চড়তে না পেরে l পরিকাঠামোর অভাবে কলকাতার বিকেন্দ্রীকরণও হচ্ছে না বোম্বে, দিল্লির মত l যার ফলে কমছে কাজের সুযোগ এবং বাড়ছেনা শহরতলির জমির দাম l উদাহরণ হিসেবে, শিয়ালদা স্টেশন থেকে যে কোন দিকে 40 কিমি গিয়ে আমরা যদি জমির দামকে তুলনা করি ছাত্রপাতি শিবাজী টার্মিনাস এর 40 কিমি দূরের কোন জমির সঙ্গে, সেটা অন্ততঃ 20 গুন তো হবেই l অথচ 1966 ই কলকাতা ও বম্বে সবদিক থেকে একই জায়গায় ছিল l গত দশ বছরে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে কল্যাণী রোড, বিটি রোড, বাসন্তী হাইওয়ে কিম্বা যশোর রোডে? উত্তরপ্রদেশ লখনৌ মেট্রো শেষ করে কানপুর মেট্রো শুরু করে দিল যেখানে রাজ্যে 50% খরচ করেছে l অথচ মমতা ব্যানার্জীর 2009 এর বাজেটে ঘোষিত 100 কিমি মেট্রোর মধ্যে মাত্র তিনটি স্টেশন আজ মানুষ ব্যাবহার করছে l JNNURM প্রকল্পে জলপ্রকল্প হয়নি কলকাতার অধিকাংশ শহরতলিতে l তিস্তা সেচ প্রকল্প বিশ বাও জলে l সুবর্ণরেখা, সিদ্ধেশ্বরী নুনবিল, দ্বারকেশ্বর গন্ধেশ্বরী প্রকল্প শুরুই হয় নি l যদিও 'জল ধরো জল ভারো ' রাজ্য সরকারের একটা সাফল্য l এছাড়া সড়ক সম্প্রসারণ নাহলেও গুনগত মানের দিকে রাজ্যের সড়কে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে l
তিন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ম্যাচিং গ্রান্ট : যে কোন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যকে 40% থেকে 50% ব্যয়ভার বহন করতে হয় l কিন্তু রাজ্যে এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে বিনিয়োগের বদলে, সরাসরি মানুষকে টাকা বন্টন করে জনপ্রিয় হওয়া শ্রেয় মনে করেছে l গত দশ বছরে কেন্দ্র থেকে রাজ্য বেশ কিছু বড় প্রকল্পের অনুদান পেয়েছে, যেমন অমৃতসর-ডানকুনি শিল্প করিডোর, লুধিয়ানা-ডানকুনি ফ্রেট করিডোর, মুম্বাই-খড়্গপুর ফ্রেট করিডোর, ইস্টকোস্ট শিল্প করিডোর, গভীর সমুদ্র বন্দর, বিভিন্ন জাতীয় সড়ক, রেল ওভারব্রিজ, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ এমনকি নতুন রেলপথ l মোট বিনিয়োগের পরিমান প্রায় তিন লক্ষ কোটি l চাকরি পেত বহু লোক l তার সঙ্গে স্থায়ী পরিকাঠামো তৈরি হবার ফলে বাড়তো জমির দাম l বিনিয়োগ হত শিল্পে l কিন্তু গত দশ বছর রাজ্যের প্রতিটি বাজেট এই ম্যাচিং গ্র্যান্টের ব্যাপারে প্রায় নীরব থেকে গেছে l ফলে আমাদের দেয়া করের পয়সায় পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে দেশের সব রাজ্যে l শুধু বঞ্চিত হয়েছি আমরা l
চার, শিল্প পরিকাঠামো l শিল্প পরিকাঠামোর জন্য দরকার সড়ক, জল এবং বিদ্যুৎ l সাধারণতঃ জল এনে দেয় সরকারই l. মূল উৎস বাধ বা সেচ খাল l কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নতুন সেচখাল বহুদিন হয় নি l অমিত বাবুও এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছেন খুবই কম l বিদ্যুতের দাম একটা নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে l কিন্তু বিদ্যুতের দামে পশ্চিমবঙ্গ উপরের দিক থেকে তৃতীয় l গত দশ বছরে অপ্রচলিত পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ক্ষেত্রে রাজ্যের বিনিয়োগ নগন্য l কয়লা বিদ্যুৎ বেশী ব্যাবহারের জন্য বিদ্যুতের দাম এখানে বেশী l এছাড়া, সড়ক তো আগেই বলেছি l দুই লেন রাস্তা শিল্পের পণ্য পরিবহনে অযোগ্য l কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ রাস্তাই চার লেন l কয়েকবছর আগে সংসদে সৌগত রায় নীতিন গতকারীকে রাস্তা নির্মাণে কেন্দ্র বৈষম্য করছে বলে অভিযোগ করায়, নীতিনজি বলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি দিলে উনি সব রাস্তা ন্যূনতম চারলেন বানিয়ে দেবেন l কিন্তু রাজ্য জমি দেয় নি l
এবার উপসংহারে আসি l পরিকাঠামো উন্নয়নের অভাবে রাজ্যে আসছে না শিল্প ও বাণিজ্য l সঙ্গে আছে সরকারের ভুল জমি, সেজ এবং বিদেশী বিনিয়োগ নীতি l 2011 তে জমি আইনে বড়সড় একটা সংস্কার আনা উচিৎ ছিল, যা সরকার করেনি l বিদ্যুতে ভর্তুকি, জলের কর, পুর কর ইত্যাদি ব্যাবস্থার যে আমূল সংস্কার সারা ভারত করছে, পশ্চিমবঙ্গ তাঁর থেকেও বিরত l আসছে না বড় বিনিয়োগ, কমছে সুযোগ এবং উত্তরোত্তর বাড়ছে বেকারের সংখ্যা l চাহিদার থেকে শ্রমিকের জোগান বেড়ে যাওয়ায় কমছে বেতন l কমছে ব্যাবসায় লাভের পরিমান l বিচার বাবস্থা ও প্রশাসনিক অপ্রতুলতায় বাড়ছে শ্রমিক শোষণ l ব্যবসার জগতে চলছে মাৎস্যন্যায় l জীবনে আসছে অস্থিরতা l সরকার সেটাকে সামাল দিতে বহু মানুষকে 100 দিনের কাজের অধীনে আনায় শোষণ কিছুটা কমছে বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও যোগানের সূত্র ধরেই l যত সমস্যা বাড়ছে, সরকার ততই সামাজিক প্রকল্পের সংখ্যা বাড়াচ্ছে l কিন্তু এর তো একটা শেষ আছে? অপরদিকে সফটওয়্যার ইত্যাদি শিল্প রাজ্যে থেকে চলে যাওয়ায়, বেশী বেতনের কর্মীরা ছাড়ছে রাজ্য l খারাপ হচ্ছে আবাসন, গাড়ি থেকে রেস্টুরেন্ট সব কিছুর বাজার l প্রতি বছর এগারো লক্ষ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে এবং সঙ্গে আছে বহু ড্রপআউট l কতদিন এই ভাবে চলবে? স্থায়ী সম্পদ না বানিয়ে কিছু সংখ্যাতত্বের খেলা আর সামাজিক প্রকল্প ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কি রেখে যাবে? অমিত মিত্রের বাজেটকে ইতিহাস কিভাবে দেখবে? শুধুই একটা জমা খরচের ইতিহাস? বিধান রায় বলতে আমরা বুঝি হলদিয়া, কল্যাণী, সল্টলেক, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, ডিভিসি, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, বান্ডেল, সান্তালদি l কি রেখে যাবেন মমতা ব্যানার্জী আর অমিত মিত্রের সরকার? কিছু 'শ্রী' এর সমাহার মাত্র?
✍️ সুদীপ্ত গুহ, বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা এবং
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির অর্থনীতি সেলের সহআহ্বায়ক।
০৯.০৭.২০২১, একদিন পত্রিকা।
P.S: Thank you, Adv Tarunjyoti Tewari for bringing this article to my notice.
.
.
.
* How India Travels
No comments:
Post a Comment